স্মার্ট বাংলাদেশ ও এনপিআর (স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার)
পটভূমি
গত কয়েক দশক ধরে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার ও এর সুফল প্রাতিষ্ঠানিকী করণের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে নানা ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ বাস্তবে রূপলাভ করেছে।টেলিযোগাযোগ, ইন্টারনেট, ডিজিটাল আর্থিক ব্যবস্থাপনা, ই-কমার্স, ই-ভূমি ব্যবস্থাপনা, ই-নথি ব্যবস্থাপনা, ই-টিকেটিং, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ও নাগরিক সেবা প্রদানে ডিজিটাল পদ্ধতির প্রয়োগে সরকার অভূতপূর্ব সাফল্যঅর্জন করেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের পর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার বা এনপিআর।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর/সংস্থা এবং ব্যক্তিগত সেবা প্রদানকারী তাদের নিজ ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ ও ব্যবহার করছে। বেসরকারি সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংগঠন ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাসমূহ তাদের নিজেদের ব্যবহারে নানাবিধ তথ্য-উপাত্ত প্রস্তুত করছে। বিভিন্ন জরিপ, শুমারি এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমের মাধ্যমে সরকার বিপুল পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত প্রস্তুত করছে। কিন্তু তথ্য-উপাত্ত প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে তথ্য-উপাত্তের দ্বৈততা পরিলক্ষিত হচ্ছে। পক্ষান্তরে সংস্থাসমূহের মধ্যে আন্তঃসমন্বয় না থাকায় পরস্পরের মধ্যে উপাত্ত বিনিমিয়করা সম্ভব হচ্ছে না।
বর্তমান পদ্ধতিতে যে কোন কাজে সনাক্তকরণের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধনের প্রয়োজন হয়। ব্যাংকের হিসাব খোলা থেকে শুরু করে স্কুল–কলেজে ভর্তি, চাকরির আবেদন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির উপকারভোগী নির্ধারণ, ইউটিলিটিসেবা, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, প্রভৃতি ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্রের ছাড়াও টিআইএন, জন্মনিবন্ধন, নমিনির এনআইডি/জন্মনিবন্ধন, পরিচয় দান কারীর তথ্য, মুঠোফোন বা টেলিফোন নম্বর, স্থায়ী ঠিকানা, বর্তমান ঠিকানা, পেশা, আয়ের উৎস, অন্যান্য ব্যাংকের হিসাব নম্বর, মাতা ও পিতার নাম প্রভৃতি নানাবিদ তথ্যের প্রয়োজন হয়। যে সকল তথ্য ব্যাংক হিসাব খুলতে প্রয়োজন হচ্ছে মোটামুটি একই রকমের তথ্য এনআইডি, টিআইএন, জন্মনিবন্ধন, মুঠোফোন রেজিস্ট্রেশন, পাসপোর্ট, চিকিৎসার সেবার জন্য নিবন্ধন কিংবা অন্যান্য নাগরিক সুবিধা গ্রহণের সময় প্রদান করতে হয়। একই তথ্য ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় প্রদান করতে হয় বিধায় একদিকে তথ্যের দ্বৈততা সৃষ্টির পাশাপাশি সময় ও শ্রমের অপচয় হচ্ছে অন্যদিকে এ সকল তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায়ও প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সেতুবন্ধনকারী হিসেবে ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার একটি একক ও সার্বজনীন তথ্য ভান্ডার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এর মাধ্যমে সকল তথ্যের দ্বৈততা পরিহার এবং নাগরিক সেবা প্রদান ও ব্যবস্থাপনায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার (এনপিআর) কী
ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার হলো কোনো দেশ/এলাকায় সচরাচর বসবাসরত বা নিবাসী সকল জনসংখ্যার তথ্যসংবলিত একক ও কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডার যা ক্রমাগত তথ্য ধারণের মাধ্যমে হালনাগাদ করণ নিশ্চিত করা হয় (জাতিসংঘ, ১৯৬৯)। এনপিআর সকল নিবাসীর জনতাত্ত্বিক ও বায়োমেট্রিক তথ্য সংবলিত একটি বিস্তৃত ও স্বয়ংসম্পূর্ণপরিচিতি তথ্যভান্ডার যার মাধ্যমে প্রত্যেক নিবাসীকে স্বতন্ত্র ভাবে সনাক্ত করা সম্ভব হয়। সাধারণত ৬ মাস বা এর অধিক সময় ধরে কোনো নির্দিষ্ট দেশ/এলাকায় বসবাস বা অবস্থান করছেন বা আগামী ৬ মাস অবস্থান করবেন এমন কোনো ব্যক্তিকেই নিবাসী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয় এবং এনপিআর–এ তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এনপিআর এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো প্রত্যেক নিবাসীর জনতাত্ত্বিক, বায়োমেট্রিক এবং প্রশাসনিক তথ্য সংবলিত একটি সুসমন্বিত জাতীয় ডাটাবেইজ (National Database) প্রস্তুত করা। এর মাধ্যমে প্রশাসনিক ও আইনি উদ্দেশ্যে ফ্যামিলি-ট্রি নিরূপণসহ প্রত্যেক ব্যক্তিকে সনাক্তকরণ, ব্যক্তির অবস্থান নির্ণয় ও তার সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা; কার্যকর ও সাশ্রয়ী পদ্ধতিতে সকল সামাজিক পরিষেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগী নির্ধারণ; জীবনের সকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা (জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, তালাক ইত্যাদি) কেন্দ্রীয় ডাটাবেইজে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ ওস্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়মিত হালনাগাদ করণের মাধ্যমে জনতাত্ত্বিক পরিসংখ্যানের সমন্বিত কেন্দ্রীয় ডাটাবেইজ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
এনপিআর এর ঐতিহাসিক পটভূমি
ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টারের একটি সুদীর্ঘ ঐতিহাসিকপটভূমি রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে চীনের “হান” রাজবংশ কর্তৃক খানা ও ব্যক্তিদের তথ্য সংবলিত প্রথম রেজিস্টার প্রস্তুত করা হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে “তাইকাপুনরুদ্ধারের” সময় জাপান এই ধরনের একটি রেজিস্টার করে ছিল। ইউরোপে এনপিআর-এর প্রাচীনতম নিদর্শন হলো সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের প্যারিশ রেজিস্টার। হাঙ্গেরি অষ্টাদশ শতাব্দীতে পপুলেশন রেজিস্টার চালু করে। বিংশ শতাব্দীতে বেলজিয়াম, চিলি, চীন, চেকোস্লোভাকিয়া, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, হাঙ্গেরি, ইতালি, জাপান, কোরিয়া, লিচেনস্টাইন, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ড, রুকু দ্বীপপুঞ্জ, স্পেন, সুইডেন এবং সুইজারল্যান্ড পপুলেশন রেজিস্টার প্রস্তুত করতে শুরু করে (জাতিসংঘ, ১৯৬৯) )। ষাট এর দশক থেকে, স্থানীয় এবং/অথবা জাতীয় পর্যায়ে পপুলেশন রেজিস্টারের উপাত্তসমূহ ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা শুরু হয় এবং নব্বই এর দশক ও তৎপরবর্তী সময়ে বেশির ভাগ ইউরোপীয় দেশস্থানীয় বা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে পপুলেশন রেজিস্টার প্রস্তুত করে। এ সকল রেজিস্টারে জনতাত্ত্বিক তথ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি প্রত্যকের জন্য পারসোনাল আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (PIN) প্রদান করে। সম্প্রতি কিছু উন্নয়নশীল দেশ সমজাতীয় পপুলেশন রেজিস্টার প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।বাংলাদেশের প্রতিবেশি দেশ ভারত ২০১১ সালের জনশুমারিও গৃহগণনার খানা তালিকা হতে ন্যাশনাল পপুলেশনরেজিস্টার প্রণয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।
আধুনিক সরকার ব্যবস্থায় তথা ই–গভ: সহজিকরনে পপুলেশন রেজিস্টার এর ইউআইডি (UID) নম্বরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভূমিকা পালন করে যার মাধ্যমে দ্বৈত সুবিধাভোগীদেরকে চিহ্নিত করণ, সম্পদের অপচয় রোধ এবং প্রকৃত সুবিধাভোগী নির্বাচন প্রভৃতি কার্যক্রম বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হয়। ভারতের জনসংখ্যা রেজিস্টার দুটি প্রধান উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত।একটি হল ২০১১ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা থেকে প্রাপ্তজন তাত্ত্বিক তথ্যের ডিজিটালাইজেশন এবং ৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সের নাগরিকদের বায়োমেট্রিক তথ্য (ছবি, ১০ আঙুলের ছাপ, উভয় চোখের আইরিস)। জনতাত্ত্বিক ও বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহের পর ডাটাবেজটিকে ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন অথরিটি অব ইন্ডিয়া (ইউআইডিএআই) এর নিকট প্রেরণ করা হয় যেখানে ইউআইডি নম্বরের দ্বৈততা যাচাই করা হয় এবং নতুন ইউআইডি নম্বর বরাদ্দ করা হয়। এটি ভারতে আধার কার্ড হিসেবে পরিচিত। দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং ১৯ টি রাজ্যে এনপিআর প্রস্তুতের কাজটি বিস্তৃত করা হয়।এনপিআর অ্যাপে আধার কার্ড, ভোটার আইডি, ড্রাইভিং লাইসেন্স, প্যান কার্ডং ও মোবাইল নম্বর ডাটাবেজে সাথে সংযুক্ত করা হয়। এমন কি ভারতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন নির্বাচন কমিশন, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক মন্ত্রণালয়, কেন্দ্রীয় আয়কর বোর্ড প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান এর মাধ্যমে তাদের নিজস্ব আইডির সাথে আধার কার্ডের সংযোগ স্থাপন করে।প্রত্যেক নিবাসীকে স্বতন্ত্রভাবে সনাক্তকরণেও পাশাপাশি অপরাধীদের সনাক্তকরণ, ফ্যামিলি ট্রি নির্ধারণ; তথ্যের দ্বৈততা (Duplication) পরিহারের মাধ্যমে সকল ধরণের জালিয়াতি রোধ; পাবলিক ডিষ্ট্রিবিউশন সিস্টেম (Public Distribution System) এর কার্যক্রম পরিচালনায় ভারতের এপিআর কার্যকর ভূমিকা পালন করছে।
ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টারের ব্যবহার
ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার প্রধানত দুটি উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে প্রস্তুত করা হয়। প্রথমত পরিসংখ্যানগত অন্যটি প্রশাসনিক। বিশ্বের ৬৫ (পয়ষট্টি) টি দেশের পপুলেশন রেজিস্টার পর্যালোচনা করে দেখা যায় এনপিআর এর মাধ্যমে সকল স্তরের বিভাজিত (disaggregated) জনসংখ্যার হাল নাগাদ উপাত্ত তাৎক্ষণিক প্রস্তুত ও সরবরাহ; অভ্যন্তরীণ অভিবাসন (Migration) ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন (Internaland Interntional Migration) পরিসংখ্যান প্রণয়ন ও নমুনা জরিপের স্যাম্পলিং ফ্রেম (sampling frame) নিয়মিত হাল নাগাদ করণ করা সম্ভব হয়। অন্যদিকে সরকার এবং অন্যান্য সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত সকল সুবিধা এবং পরিষেবার যথাযথ পরিবীক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে যথাযথ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য এনপিআর গুরৃত্বপূর্ণ ভূমিকাপালন করে। এনপিআর রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনা; জমিসংক্রান্ত বিরোধ/মামলা নিষ্পত্তি; কর বিরোধ (Tax Dispute) নিষ্পত্তি, ব্যক্তি, খানা ও পরিবার সনাক্তকরণ; অপরাধী সনাক্ত করণ, ফ্যামিলি ট্রির মাধ্যমে উত্তরাধিকার বিরোধ নিষ্পত্তি এবং নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণে হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করার মাধ্যমে প্রশাসনিক কার্যক্রম সহজিকরণে এনপিআর অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।
জনমিতিক পরিসংখ্যান, জনশুমারি ও ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার
দেশের জনসংখ্যা, জনসংখ্যার কাঠামোগত পরিবর্তন, বাসস্থান, শিক্ষা, ধর্মীয় বিশ্বাস, বৈবাহিক অবস্থা প্রভৃতি জনমিতিক তথ্যের জন্য পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও সাধারণত ১০ বছর অন্তর জনশুমারি ও গৃহগণনা আয়োজন করা হয়। আন্ত:শুমারি বছর গুলোতে নমুনা জরিপের মাধ্যমে এ সূচক সমূহের Estimate প্রদান করা হলেও আর্থ সামাজিক অবস্থার সামগ্রিক চিত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণার জন্য বৃহত্তম ও নির্ভরযোগ্য উৎস হলো জনশুমারি ও গৃহগণনা। এ সংক্রান্ত হাল নাগাদ তথ্য-উপাত্তের জন্য সরকার, নীতি নির্ধারক, পরিকল্পনাবিদ ও গবেষকদের এজন্য ১০ বছর অপেক্ষা করতে হয় বিধায় সরকারি পরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে শুরু করে উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নে নির্ভরযোগ্য উপাত্তের বিকল্প উৎস অতীব জরুরি। ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার প্রণয়ন করা সম্ভব হলে জনমিতিক বিভিন্ন সূচকের তথ্য যে কোনো সময় (Real Time) প্রণয়ন করা সম্ভব হবে। এছাড়া ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার ব্যবহার করে অন্যান্য দেশ যেমন: দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, নরওয়ে এর মতো রেজিস্টার বেইজড শুমারি করা সম্ভব হবে। ফলে বর্তমান পদ্ধতিতে জনশুমারির মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নে অর্থ, সময় ও শ্রমের অপচয় রোধ করা যাবে।
জনশুমারি ও গৃহগণনা একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। প্রতিটি শুমারির পর দেশ-বিদেশে হইচই শুরু হয়ে যায়। কেউ জনশুমারির গণনা হতে বাদ পড়েছেন, কেউ হয়তো দুইবার অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন আবার কারও খানা বা পরিবার হয়তো একবারেই বাদ পড়েছেন এ ধরনের অভিযোগ প্রায়শ পাওয়া যায়। আবার গণনায় অন্তর্ভুক্ত হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বয়স, কর্মসংস্থান, শিক্ষাগত যোগ্যতা, ধর্মীয় বিশ্বাস, বৈবাহিকঅবস্থা, খানার বৈশিষ্ট্য এরূপ বিভিন্ন তথ্য লিপিবদ্ধ করণে ভুল পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে অন্যান্য প্রশাসনিক রেজিস্টারের সাথে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ তথা এনপিআর প্রণয়ন করা হলে সকল ধরণের দ্বৈততা পরিহার, সকল ব্যক্তি ও পরিবারের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করণ ও নিখুঁত জনমিতিক পরিসংখ্যান প্রণয়ন করা সম্ভব হবে। ভালনারেবল গ্রুপ, প্রতিবন্ধিতা বা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তি, তৃতীয় লিঙ্গ/হিজড়া/ট্রান্সজেন্ডার প্রভৃতি বিভাজিত পরিসংখ্যানের হাল নাগাদ উৎস হতে পারে ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার। তাই ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার নিঃসন্দেহে স্মার্টবাংলাদেশ বিনির্মাণের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
প্রশাসনিক কার্যক্রমে ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার
সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে শতাধিক সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় নগদ/সামগ্রীতে ভাতা প্রদান করে থাকে। সঠিক রেজিস্টার বা তথ্যের অভাবে ভাতা ভোগী/উপকার ভোগী নির্বাচনে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সঠিক উপকারভোগী নির্বাচনে দ্বৈততা পরিহার, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, চাকরির আবেদন প্রভৃতিক্ষেত্রে ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার তথ্য যাচাইয়ের প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রতিটি পরিবার ও খানার টেকসই দ্রব্য সামগ্রীর বিবরণ এনপিআরে লিপিবদ্ধ করে প্রক্সি মিন টেস্ট (Proxy mean test) এর মাধ্যমে ভালনারেবল গ্রুপ নির্ধারণ করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ভূমির মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে এনপিআর অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। পারিবারিক ট্রি ব্যবহার করে ভূমির মালিকানা ও উত্তরাধিকারী নির্ধারণে বিদ্যমান জটিলতা অনেকাংশেই হ্রাস করা সম্ভব হবে।
জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোনো দেশের সকল নিবাসীকে স্বতন্ত্রভাবে সনাক্তকরণ অপরিহার্য। ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টারে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য একটি ইউনিক আনডেন্টিফিকেশন নম্বর প্রদানও পারিবারিক সম্পর্কের একটি ট্রি স্থাপন করা হয় যার মাধ্যমে প্রত্যেক ব্যক্তি ও পরিবারকে সহজেই সনাক্ত করা সম্ভব হয়। এছাড়া ইমিগ্রেশনএর উপাত্ত ব্যবহার করে আগমন ও বহির্গমন সংক্রান্ত সকল উপাত্ত এনপিআরে লিপিবদ্ধ করা হয়। ফলে দেশের অভ্যন্তরে বিদেশি নাগরিকের গতিবিধি সহজেই সনাক্ত করা সম্ভব হয়। পাশাপাশি এনপিআরের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো সকল নিবাসীর ঠিকানা পরিবর্তন লিপিবদ্ধকরণ অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি কোনো স্থান হতে অনত্র স্থানান্তর হলে একটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উক্ত এলাকার নির্ধারিত পয়েন্টে তার বর্তমান ঠিকানা রেজিস্টার করা প্রয়োজন হয়। তাইদেশের অভ্যন্তরে যে কোনো ব্যক্তির গতিবিধি নজরদারি করা সম্ভব হয়। ফলে এনপিআর জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার প্রণয়নে আইনগত ভিত
পরিসংখ্যান আইন, ২০১৩ এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সকল পরিসংখ্যান কার্যক্রম, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ (SID) এর অধীনস্ত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) উপর ন্যস্ত। একই সাথে আইনের ধারা ৬ (তে) অনুযায়ী জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টারের উন্নয়ন, হালনাগাদ করণ সহ রেজিস্টারের সার্বিক কার্যক্রম সম্পাদনে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোই দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান।এলোকেশন অব বিজনেস অনুযায়ী (বাংলাদেশ সরকার, ২০১৭) পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের নির্দেশনায়/পরামর্শে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টারের (NPR) উন্নয়ন কার্যক্রমে সহায়তা করবে। তাছাড়া, মন্ত্রিসভা কর্তৃক অনুমোদিত পরিসংখ্যান উন্নয়নের জন্য জাতীয় কৌশলপত্র (এনএসডিএস) অনুযায়ী বিবিএস এনপিআর বাস্তবায়ন করবে। সুতরাং, আইনগতভাবে, প্রশাসনিক দলিলে (অর্পিত দায়িত্বভার) এবং সরকারের কৌশলগত নথিতে এনপিআর এর আইনগত ভিত্তি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তীতে ৮ম পঞ্চবার্ষিকপরিকল্পনায় এটি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি কার্যক্রম হিসেবেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অতএব ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার প্রণয়নে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগাধীন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজকরতে পারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক দেশব্যাপী শুমারি পরিচালনার অভিজ্ঞতা এ কাজে সহায়ক ভূমিকাপালন করতে পারে।
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার (এনপিআর)
– মোঃ মোবারক হোসেন, উপপরিচালক, বিবিএস
৩১তম বিসিএস ক্যাডার এসোসিয়েশন
https://31stbcs.org/beyond-the-wall-by-stephen-shore/
৩১তম বিসিএস ক্যাডার এসোসিয়েশন
৩১তম বিসিএস ক্যাডার এসোসিয়েশন