কল-রেডী
ছোটবেলা থেকে দেখি কোন অনুষ্ঠান বা প্রোগ্রামে মাইক ব্যবহার করলেমাইক্রোফোনের সামনে লেখা থাকে ‘কল–রেডী’!
মনে মনে ভাবতাম কে এই কল–রেডী কিংবা কল–রেডী কেন লিখে! অনেক প্রশ্ন জমা থাকতো মনে এটা নিয়ে।
ক্ষুদ্র জ্ঞানে বলতে চাই ‘কল–রেডী’র ইতিহাস।
আমার মত অনেকেই হয়তো এমনই ভাবতেন, আপনাদের জানানোর জন্যই এই আয়োজন।
করোনা কিছুটা কমে গেলেও, ওমিক্রন ভ্যারাইটি নিয়ে আমরা এখনোকিছুটা আতঙ্কিত, অনুরোধ থাকবে এরই ফাঁকে একটু চোখ বুলিয়েজেনে নিন কল–রেডীর ইতিহাস।
কল–রেডী, বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী মাইক পরিষেবা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে বিভিন্ন আন্দোলনে প্রায় সব সময় এমাইক সার্ভিসটি ব্যবহার করা হয়েছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময়সভা ও সমাবেশে এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ।
বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ ছাড়ও বাংলাদেশে বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের নিয়ে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানেও কল–রেডী ব্যবহার করা হয়েছে।
যারা কল–রেডীর মাইক দিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন– ইন্দিরা গান্ধী, ইয়াসির আরাফাত, নেলসন ম্যান্ডেলা, বিলক্লিনটন, প্রণব মুখার্জি ও অটল বিহারী বাজপেয়ী।
ঐতিহ্যগতভাবে এদেশে এখনো বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অধিকাংশসময় কল–রেডী ব্যবহার করেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কেফজলুল হক, শেখ হাসিনাসহ আরো অনেকে আছেন এই তালিকায়।
ভাষা আন্দোলনের দাবিতে সমাবেশ ও বিক্ষোভের সময় মাইকসার্ভিসের জন্য ‘কল–রেডী’ নামটি ঠিক করা হয়।
ব্রিটিশ শাসনের অবসান আর দেশভাগের পর পর পুরো ভারতীয়উপমহাদেশেই তখন পরিবর্তনের হাওয়া।
তখন পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের বিখ্যাত ঘোষ পরিবারের থান কাপড়েররমরমা ব্যবসা।
ইতিহাসের সেই নতুন অধ্যায়ের সূচনায় থান কাপড়ের পারিবারিকব্যবসায় মন গেল না সূত্রাপুরের ঘোষ পরিবারের দুই ভাই হরিপদ ঘোষও দয়াল ঘোষের।
১৯৪৮ সালে তারা থান কাপড়ের ব্যবসা বাদ দিয়ে শুরু করলেন বাহারিবাতির ব্যবসা, নাম দিলেন আরজু লাইট হাউজ।
আলোকসজ্জার লাইটের পাশাপাশি গ্রামোফোন ভাড়া দিত লাইটহাউজ। বিয়ে–শাদী ও নানা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে লোকজনেরআনাগোনায় অল্প সময়েই পরিচিতি পেয়ে যায় তাদের দোকান।
চাহিদা বাড়তে থাকায় ভারত থেকে কিছু মাইক নিয়ে আসেন দুই ভাই।যন্ত্রাংশ এনে হরিপদ নিজেও হ্যান্ডমাইক তৈরি করা শুরু করেন।
দেশভাগের কিছু পরই নানা কারণে আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে।বাড়তে থাকে নেতাকর্মীদের মাইকের প্রয়োজন।
পাশাপাশি নানা সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মাইকের চাহিদা থাকায়তারা তখন লাইট হাউজের নাম বদলের সিদ্ধান্ত নেন তারা।
নাম দেন, “কল–রেডী” !
এই নাম দেয়ার পেছনেও আছে গল্প!
নামের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, ‘মাইক যারা ভাড়া করবেন তারা কল (ডাকলে) করলে যাতে তাদের প্রতিষ্ঠান রেডী (প্রস্তুত) থাকেন।’
অর্থাৎ কল করলে মাইক নিয়ে রেডী।
সে ভাবনা থেকেই ‘কল–রেডী’ নামটি এসেছে।
পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের লক্ষ্মীবাজারের দুই সহোদরের হাতে‘কল–রেডী’র গোড়াপত্তন। হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ নামের দুই ভাই প্রতিষ্ঠা করেন এ মাইকসার্ভিস।
গোপাল আর কানাই ঘোষ নামের আরও দুই ভাই কাজে সহায়তাকরতেন তাদের।
বর্তমানে দয়াল, হরিপদ, গোপাল ও কানাই ঘোষ– তাদের কেউ আরবেঁচে নেই।
হরিপদ ঘোষের চার ছেলে কল–রেডী দেখভাল করছেন এখন। এরমধ্যেত্রিনাথ ঘোষ সাগর আছেন পরিচালক হিসেবে।
৩৮ বছর বয়সী সাগরের কাকা কানাই ঘোষ মারা গেছেন ২০১৬ সালে।বাবা হরিপদ ঘোষ গত হয়েছেন এক যুগের ও বেশি আগে। সহোদরদেরসহায়তায় পারিবারিক ব্যবসাটি ধরে রেখেছেন সাগর।
তাঁদের একটাই ইচ্ছে বর্তমানে, যে মাইকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় মুক্তির ডাক দিলেন, যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঘোষণা দিলেন;
সেই মাইকের প্রতি সরকারের দৃষ্টি চান পরিবারের সদস্যরা।
এবার আসুন ৭ই মার্চের ঘটনায়— ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের পূর্বে শেখমুজিবুর রহমান তার ধানমন্ডির বাসভবনে হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষদুজনে ডেকে রেসকোর্সে ময়দানে মাইক প্রস্তুত করতে বলেন।
কাজে নেমে পড়েন হরিপদ ও দয়াল ঘোষ।
তখন রেসকোর্সে মাইক লাগানো সোজা ছিল না–শাসকগোষ্ঠীর চোখছিল সদা সতর্ক।
রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে মাইক লাগাতে লাগলেন দুই ভাই।
৭ই মার্চের বাকি আর তিন দিন।
মাইক লাগিয়ে কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন হরিপদ আর দয়াল ঘোষ।
কিছু বাড়তি মাইক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মজুদ রাখেন যেন সমাবেশের দিন তাৎক্ষণিকভাবে লাগিয়ে নিতে পারেন।
তিন দিন ধরে ৩০ জন কর্মী নিয়ে বাঁশ, খুঁটি গাঁথার কাজ করেন ঘোষেরা।
তারপর সেই দিনটি আসে–৭ই মার্চ।
কবি গিয়ে দাঁড়ান জনতার মঞ্চে। মুখের সামনে কল–রেডী।
বঙ্গবন্ধু তর্জনী দেখিয়ে বলে ওঠেন তার কবিতাখানি– ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।‘
বর্তমানে ৩৬, এইচকে দাস রোড, লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর থেকে অত্যন্ত সুনামের সাথে একনিষ্ঠ সেবা দিয়ে যাচ্ছে কল–রেডী।
আপনি এখনো গেলেই দেখতে পাবেন— ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে যে মাইক্রোফোনে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন– সেইমাইক্রোফোন, মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ড আজও আছে তাদের কাছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আর অন্য কেউ সেই মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দেননি।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আবারও সেই মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
সেই মাইক এখনো তাদের কাছে সংরক্ষিত আছে।
বঙ্গবন্ধু যে টেবিলটি (পোডিয়াম) সামনে দাঁড়িয়ে, তার ওপর চশমা রেখে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেটি ও এখনো আছে।
আপনি চাইলেই যেতে পারেন, একদিন গিয়ে দেখে আসতে পারেনবাংলার জ্বলন্ত ইতিহাস– কল–রেডী’র সেই বিখ্যাত মাইক্রোফোন, সেই স্ট্যান্ড, সেই পোডিয়াম (যেখানে বঙ্গবন্ধু চশমা রেখেছিলেন) !
লেখক-
মোহাম্মদ আরিফুল আলম
উপ কর কমিশনার
বৃহৎ করদাতা ইউনিট
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
(৩১তম বিসিএস ট্যাক্স) ৩১তম বিসিএস ক্যাডার এসোসিয়েশন


Outbound links e.g.
গল্প হলেও সত্যি
https://www.rokomari.com/book/author/84669
https://31stbcs.org/%E0%A6%95%E0%A6%B2-%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%A1%E0%A7%80/