মুক্তিযুদ্ধ ও শিশুর প্রতি অমানবিকতা
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভ বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন।মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা পৃথিবীর যেকোনো নিষ্ঠুরতাকে হার মানিয়েছে।যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও মা-বোনের সম্ভ্রম হানির ঘটনা ঘটেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের মধ্যে ৪ লাখই ছিলো শিশু-কিশোর।আর যেসব নারী সম্ভ্রম হারেয়েছেন তাদের মধ্যে অর্ধেকই ছিলো কিশোরী।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন করতে বড়দের সাথে মাঠে নেমেছিল শিশুরাও।শিশুরা রাতের আধারে এবং বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করছে।তারা মুক্তিযোদ্ধাদের আর্মি ক্যাম্প, আল বদর,আল শামসের অবস্থানের তথ্য দিতেন।প্রয়োজনে তারা নিজেরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধ করেছে।
আমরা জানি মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে ভারতে ১ কোটি বাঙ্গালি আশ্রয় নিয়েছে। শরনার্থীদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক মারা গেছে যা নিয়ে আজও পর্যন্ত কোন আলোচনা হয়নি।জন সিম্যান ও দিলিপ মহালনবিশের নিবন্ধের আলোকে ধারনা পাওয়া যায় কলেরা,ডায়রিয়া ও অন্যান্য মহামারিতে ৩ লাখের ও বেশি শরনার্থী মারা গেছে। কলেরা ও ডায়রিয়ায় বেশিরভাগ মারা গেছে শিশুরা।

আমরা যুদ্ধ শিশু কোহিনূরের কথা কতজন মনে রেখেছি! একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের যুদ্ধ শিশু কোহিনূর বার বার নরওয়ে থেকে তার মা-বাবার খোঁজে বাংলাদেশ আসছেন। তাকে ১৯৭২ সালে যুদ্ধ শিশু হিসেবে দত্তক নেন নরওয়ের এক দম্পতি। তিনি নরওয়ের রাজধানী অসলোতে বসবাস করছেন।তিনি জানান নরওয়েতে একশ’র মত বাংলাদেশী যুদ্ধ শিশু আছেন যার নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। এরকম বহু যুদ্ধ শিশু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন যারা তাদের বাবা মায়ের সন্ধান আজও পায়নি।
১৯৭১ সালে মে মাসে “The New York Times ” এর প্রতিনিধি সিডনি শনবার্গ একটি প্রবন্ধে লিখেছেন – সাব্রুম এর একটি শরনার্থী ক্যাম্পে আনুমানিক ৪৫ বছর বয়স্ক এক নারী ১৬ বছর বয়সী দুই যমজ মেয়েকে ফিরিয়ে আনার জন্য কাকুতি মিনতি করছে।চোখে মুখে আতঙ্ক নিয়ে সে নারী আমাকে বলছেন পাকিস্তানি সৈন্যরা তার বাড়িতে আগুন দিয়ে তার দুই কিশোরী মেয়েকে টেনে- হিচড়ে নিয়ে গেছে।
মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অমানবিকতার শিকার হয়েছে নারী ও শিশুরা। নারী বলতে বেশিরভাগ ছিলো ১২-১৬ বয়সী কিশোরী শিশুরা।পাক জান্তা ও এদেশীয় দোসররা শিশুকে হত্যা ও নির্যাতন করে মুক্তিযোদ্ধা ও বীর বাঙালির মনোবলকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে।যেমন নাটোরের বর্তমান এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কারনে রাজাকারা তাঁর শিশু সন্তনকে ওয়ালের সাথে আচড়িয়ে হত্যা করে।হাজার হাজার শিশুরা যুদ্ধের পর তাদের বাবা -মাকে আর খুজে পায়নি।বিশেষ করে কিশোরী শিশুরা সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ ছিলো। পাক জান্তারা তাদের গন দর্শন করছে এমনকি দর্শন করে মেরে ফেলেছে।

শিশুর প্রতি যুদ্ধের সময়কার অমানবিকতার ধারাবাহিকতা যুদ্ধের পরও বহমান রয়েছে।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে আমরা দেখতে পাই শিশু হত্যার পাশবিক লীলা। শেখ রাসেল, সুকান্ত আব্দুল্লাহ ও বেবির মত শিশুদের ঘাতকরা সেদিন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে।এ দায় আমাদের সকল জাতি সত্তার। কেননা এর পূর্ণাঙ্গ বিচার আজও আমরা করতে পারিনি।
আমরা প্রতিজ্ঞা করি- এ পৃথিবীকে আমরা শিশুদের জন্য নিরাপদ বাসযোগ্য করে যাব।
লেখক,
সবুজ হাওলাদার, পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, কেরাণীগন্জ ঢাকা।