বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন পরিকল্পনায় জনসংখ্যা ভাবনা

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ দূরদর্শী নেতৃত্বে ত্রিশ লক্ষ শহীদ দুই লক্ষ মাবোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতার লাল সূর্য বাঙ্গালীর কাছে ধরা দেয়।বাঙ্গালীরা অর্থাৎ, তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের অধিবাসীরা ঐতিহাসিকভাবেই শোষণ, বঞ্চনা লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে এবং কারণে প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কোন ভাগ্যোন্নয়ন হয়নি। জাতির পিতার মূল লক্ষ্য ছিল বাঙ্গালীদের মুকে হাসি ফোটানোস্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলা। উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পরপরই যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। তিনি তাঁর উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রে রেখেছিলেন বাঙ্গালীর দু:দারীদ্র্যমুক্ত সুখী জীবন। উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রকে তিনি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছিলেন, যার প্রতিফলন ঘটেছে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রবর্তিত প্রথম সংবিধানে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদেও উল্লেখ করা হয়েছে-“রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদন শক্তির ক্রম বৃদ্ধি সাধন এবং জনগণের জীবন যাত্রার বস্তুগত সংস্কৃতি গতমানের দৃঢ় উন্নতি সাধন।

১৭৯৮ সালে ইংরেজ অর্থনীতিবিদ থমাস ম্যালথাস তাঁর An Essay on the Principle of Population বইয়ে যুগান্তকারী জনসংখ্যা তত্ত¡ প্রকাশ করেন

ম্যালথাসের মতে অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা জ্যামিতিক হারে অর্থাৎ , , , ১৬ এই হারে বাড়ে, পক্ষান্তরে উৎপাদন বাড়ে গাণিতিক হারে অর্থাৎ ,,,, এই হারে। নিয়ন্ত্রণহীন জনসংখ্যা খাদ্য সরবরাহের অপ্রতুলতা সৃষ্টি করে এবং প্রকৃতিতে খাদ্য সরবরাহ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল থাকে যার অবধারিত ফল হলো দুর্ভিক্ষ, মহামারী, মৃত্যু এবং জনসংখ্যা হ্রাস। ২০১৫ সালে প্রকাশিত An Emperical Analysis of Population Growth on Economic Development: The Case Study of Bangladesh শীর্ষক লেখনীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, জনসংখ্যাবৃদ্ধি মোট দেশজ উৎপাদন (Gross Domestic Product) এর মধ্যে একটি নেতিবাচক পারস্পরিক সম্পর্ক (Negative Correlation) বিদ্যমান। এখানে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, যদি জনসংখ্যার % বৃদ্দি হয়, তাহলে মোট দেশজ উৎপাদন.৯৫ % হ্রাস পায়।

১৯৬১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান তথা বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল কোটি ২৮ লক্ষ যাঅতিদ্রæ বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৭৩ সালে হয়েছিল কোটি ৪০ লক্ষ এবং তখন জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল .৩০। সময় জনসংখ্যা বিশারদগণ প্রক্ষেপণ করেছিলেন যে, যদি উক্ত হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে তাহলে আগামী ২৩ বছরের মধ্যেবাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুন হবে এবং তখন প্রতি বর্গমাইলে ২৬৮০ জন লোক বসবাস করবে যা সার্বিক অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করবে। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্র্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩১৯৭৮) জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেন। উক্ত পরিকল্পনায় সকল মন্ত্রণালয় বিশেষ করে পল্লী উন্নয়ন, কৃষি, শিক্ষা, শ্রম সমাজকল্যাণ এবং তথ্য মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয় করে জনসাধারণকে পরিকল্পিত পরিবার গঠনে তথ্য প্রদান, উদ্বুদ্ধকরণ সেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদানে কাজ করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং সেই সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সভাপতি করে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় জনসংখ্যা পরিষদ (National Population Council) গঠনের কথা বলা হয় যেটির প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই পরবর্তিতে প্রবর্তিত জাতীয় জনসংখ্যা নীতিতে। এই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক বিভিন্ন কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নে ৭০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে বলেও উল্লেখ করা হয় এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ১৯৭৮ সালের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার .৮০ হ্রাস করা জনসংখ্যার পরিমাণ  কোটি ৫৪  লক্ষের মধ্যে সীমিত রাখা সম্ভব হবে বলে প্রক্ষেপন করা হয়। পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক কার্যক্রমের সুষ্টু সমন্বয় কাজের অগ্রগতি সাধনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমানের নির্দেশেই ১৯৭৪ সালে প্রথম বারের মতো স্বতন্ত্র পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ গঠন করা হয়।

১৯৭৫ সালের ২৫ শে জানুয়ারী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর উপর প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধুর গভীর রাজনৈতিক জনমিতিক প্রজ্ঞা দৃষ্টিভঙ্গি আরও সুচারুভাবে ফুটে উঠেছে। উক্ত ভাষণের মধ্যে তিনি বলেছিলেন, “ দেশেমানুষ বাড়ছে। বৎসরে ত্রিশ লক্ষ লোক বাড়ে। আজকে আমাদের তাই পপুলেশন প্ল্যানিং করতে হবে না হলে ২০ বছর পরে ১৫কোটি লোক হয়ে যাবে। আর ২৫ বছর পরে ? ……..৫৪ হাজার স্কয়ার মাইল জায়গায় এত লোক বাঁচাতে পারবো না। যত ক্ষমতাই থাকুক, বাঁচার উপায় নাই। অতএবপপুলেশন কন্ট্রোলআমাদের করতেই হবে। সেজন্য ডেফিনিট স্টেপ আমাদের নিতেই হবে বাংলাদেশে।এরপর ১৯৭৫ সালের ২৬ শে মার্চ ঐতিহাসিক সোহ্রাওয়ার্দি উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণেও বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘‘ ভাইয়েরা আমার, একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রত্যেক বৎসর আমাদের ৩০লক্ষ লোক বাড়ে আমার জায়গা হল ৫৫ হাজার বর্গমাইল যদি প্রত্যেক বৎসর ৩০ লক্ষ লোক বাড়ে তা হলে ২৫৩০ বৎসরে বাংলার কোন জমি থাকবে না হাল চাষ করার জন্য বাংলার মানুষ, বাংলার মানুষের মাংস খাবে সে জন্য আমাদের পপুলেশন কন্ট্রোল, ফ্যামিলি প্ল্যানিং করতে হবে।

১৯৭৫ সালের ১৫ মে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়পপুলেশন প্ল্যানিংবিষয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগেএকটি আন্তর্জাতিক সেমিনার অয়োজন করা হয় যেখানে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ), বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধি ছাড়াও ৩০ টি দেশের প্রতিনিধিগণ অংশগ্রহণ করেছিলেন। উক্ত সেমিনারে বঙ্গবন্ধুর লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের তৎকালীন সচিব অধ্যাপক কে. . খালেক যেখানে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান উল্লেখ করেন যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান চিত্র জাতীয় উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। তাই, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যসুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণই হলো দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত।

জনসংখ্যা প্রক্ষেপণ অনুযায়ী যদি কাঙ্খিত জন উর্বরতার হার অর্জন তা বজায় রাখা যায়, তাহলে আগামী ২০৫০ সালেবাংলাদেশের জনসংখ্যা স্থিতাবস্থায় পৌঁছাবে যখন মোট জনসংখ্যা হবে প্রায় ২৩ কোটি বাংলাদেশের মত এই স্বল্প আয়তনের দেশে এই প্রক্ষেপিত জনসংখ্যাই অত্যাধিক বলে বিবেচিত। অত্যাধিক জনসংখ্যার চাপ মেকাবিলা করতে সরকারকে অতিরিক্ত খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসাসহ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হচ্ছে।  এতে বাসযোগ্য ভূমির ব্যবস্থা করতেযেয়ে চাষযোগ্য কৃষি জমির পরিমাণ দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে দেশে খাদ্য ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হবে যদি আমরা এখনই আমাদের জনসংখ্যাকে কাঙ্কিত মাত্রায় নিয়ে আসতে না পারি। উপরন্তু, অধিক জনসংখ্যার প্রভাবে দেশে বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে যা অদূর ভবিষ্যতে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর প্রকৃত সংখ্যা তথা উবঢ়বহফবহপু জধঃরড়বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখবে যদিও বর্তমান সরকার জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করাসহ নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির লক্ষ্যেব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছ তথাপি প্রতিনিয়ত দেশের মোট কর্মক্ষম লোক যোগ হচ্ছে যা সরকার গৃহীত কার্যক্রমকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এমতাবস্থায়, টেকসই উন্নয়নের স্বর্থে আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠীকে দক্ষ করে গড়ে তুলে জনমিতিকলভ্যাংশ অর্জনের পাশাপাশি আমাদের সকলকে পরিকল্পিত পরিবার গঠনের দিকে আরও মনোযোগী হতে হবে। যদি আমরা জনসংখ্যাকে কাঙ্খিত মাত্রায় সীমিত রেখে জনগণকে জনসম্পদে পরিণত করতে পারি, তবেই আসবে আমাদের কাঙ্খিত অর্থনৈতিক মুক্তি; আমরাই পারবো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে।

বঙ্গবন্ধু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করাসহ জাতীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যহারের মাধ্যমেস্বাধীনতা অর্জনের পর অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্য যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তার বাস্তবায়নে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণকরেছিলেন, সেটিই আজ বাস্তবায়িত হচ্ছে আরও বড় পরিসরে। বঙ্গবন্ধুর এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন গভীর প্রজ্ঞা, জনমিতিক ভাবনা দর্শন বাংলাদেশের জনগণ পরম শ্রদ্ধায় কৃতজ্ঞ চিত্তে চিরকাল স্মরণে রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।

সহায়ক গ্রন্থাবলী:

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান।

Ali. S. Alam, K. J., Islam, S.  Hossain, M. (2015), An Emperical Analysis of Population Growth on Economic Development: The Case Study of Bangladesh, International Journal of Economics, Finance and Management Sciences, 3(3)|

Chowdhury, Md. Niaz Morshed and Hossain Md. Mobarak (2018), Population Growth and Economic Development in Bangladesh: Revisited Malthus, Department of Economics, University of Nevada Reno, Reno, USA|

Bangladesh: A Fortnightly News Bulletin, June 15, 1975, Press & Information Division, Embassy of Bangladesh, 2123, California Street, N.W., Brighton Hotel, Washington, DC, 20008|

প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ১৯৭৩-১৯৭৮

লেখক, 

প্রবীর কুমার সেন

ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (কোয়ালিটি এ্যাসূরেন্স), উপকরণ সরবরাহ ইউনিট, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *