ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল্লাহ আল মামুন
নির্বাহী প্রকৌশলী, গণপূর্ত অধিদপ্তর
অনেক চড়াই-উৎরাই পার করে যখন পদ্মাসেতু আপন মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। আজকের এই পদ্মা সেতুর প্রেক্ষাপট কমবেশি সকলেরই জানা। তারপরও একে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সেতুর নির্মাণ ব্যায়ের সাথে তুলনা। সেতুর টোল নিয়েও সমালোচনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অকৃত্রিম সাহস ও ভালবাসার ফসল এই পদ্মা সেতু। তাঁর ঐকান্তিক চেস্টায় এটা আলোর মুখ দেখল। স্বাধীন বাংলাদেশের এটা সবচেয়ে বড় অর্জন। বিশ্বের বুকে আজ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে আমাদের দেশ। সম্পুর্ন দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা ব্রিজ নির্মিত হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রনালয় হতে ঋন নিয়ে সরকার এটা নির্মান করেছে। আমরা বলি নিজেদের টাকায় হলে টোল কেন দিব??
এখন ভাবুন জনগনের ট্যাক্স বা রাজস্ব দিয়েই সরকার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। এদেশের সরকারি সব কিছুই ত জনগনের ট্যাক্সের টাকায় নির্মিত। সরকারি রেলে কি ফ্রি চড়েন, ফেরি কি মাগনা পার হন? BRTC বাসে কি ফ্রি চড়েন? সরকারি প্রতিষ্ঠানে কি ফ্রি সার্ভিস পান? উত্তর না! সব জায়গায় এক্টা নুন্যতম ফি নেয়া হয় তা না হলে সরকার চলবে কিভাবে? সমগ্র বিশ্বেই এই সিস্টেম। অনেক ক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি দেয় জন্য চার্জ বা দাম অনেক কম পরে।ফ্রি সব খানে দিলে ত সরকার দেউলিয়া হবে।
এবার আসি টোল নিয়ে। টোল যা ধার্য করা হয়েছে তা অত্যন্ত যৌক্তিক। ৬.১৫ কিমি সেতু মাত্র ৬ মিনিটে পার হবেন আগে যেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা ভোগান্তি হত ফেরিতে, লঞ্চে, স্পিড বোটে। মনে রাখতে হবেTime equals to money!! এক্টা ৪০ সিটের বাসের জন্য হিসেব করলে দেখুন টোল ফেরির তুলনায় খুব বেশি না প্রতি সিট মাথাপিছু খুব বেশি বাড়েনা (১৫-২০ টাকা)। অথচ এই ১৫ টাকার জন্য একজনকে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হতো।
তাছাড়া ফেরি উঠতে পল্টুন ফি দিতে হয় সেটা কিন্তু কেউ হিসেবে আনছেন না।
৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মা সেতুর দুই পাড়ের অংশসহ এর মোট দৈর্ঘ্য ৯ কিলোমিটার। ৬ লেন বিশিষ্ট এই সেতুর প্রস্থ ১৮.১০ মিটার বা ৭২ ফুট। তাই শুধু এর দৈর্ঘ্য তুলনা করলে হবেনা। পদ্মাসেতুর আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছে ১০০ বছর, যা ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল করে তৈরি করা হয়েছে। এর জন্যও খরচ বেড়েছে। আমাজনের পরে পদ্মা বিশ্বের দ্বিতীয় খরস্রোতা নদী, আর এই পদ্মার বুকে সেতু তৈরি করতে গিয়ে বিভিন্ন রকম প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয়েছে। শুরুর দিকে শুধু সড়ক সেতু করার কথা থাকলেও পরে রেল সেতু যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। এতে স্বাভাবিকভাবেই ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার কথা।
তাছাড়া, পদ্মাসেতুর পিলার স্থাপন করতে গিয়েও জটিলতা তৈরি হয়। কাজ শুরুর পর বিভিন্ন কারণে ২২ টি পিলারের নকশা পরিবর্তন করতে হয়েছিলো। তখন বিশ্বের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পরামর্শ নেয়া হয় এবং পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়। এখানেও খরচ বেড়েছে। এই ২২ টি পিলারের প্রতিটিতে ৬ টি পাইলের স্থলে ৭ টি পাইল স্থাপন করতে হয়েছে। প্রতিটি পাইলের দৈর্ঘ্য ১২২ মিটার বা ৩৮৩ ফুট যা একটি ৪০ তলা বিল্ডিংয়ের চেয়েও বড়। পদ্মাসেতুর পাইল বিশ্বের দীর্ঘতম পাইল, আর এরকম পাইল বসেছে ২৬৪ টি। তাই এখানেও খরচ বেড়েছে।পদ্মা অত্যন্ত খরস্রোতা নদী হওয়ায় এর নদী শাসনেই খরচ হয়েছে ৮৭০৭ কোটি টাকা, যা সারা বিশ্বের কোথাও করতে হয়নি। এছাড়া এই পদ্মাসেতুর পাইলিং এর জন্য বিশ্বের বৃহত্তম হ্যামার আনা হয়েছিলো জার্মানি থেকে, তাছাড়া বিশ্বের বৃহত্তম ক্রেন দিয়ে এই সেতুর স্প্যানগুলোকে পিলারের উপর স্থাপন করা হয়েছে। এতো কিছুর পরেও কি খরচ বেশি হবেনা!
এতোকিছু জানার পরও কিছু মানুষ সমালোচনা করবেই। তারা বিভিন্ন রকম যুক্তি দাড় করাবেই। কিন্তু তাদের সমালোচনা হলো ভিত্তিহীন সমালোচনা, কোন গঠনমূলক সমালোচনা নয়। আবার কিছু মানুষ পদ্মা সেতুর টোলের পরিমান নিয়েও সমালোচনা করেছে, কিন্তু তারা কি জানে কতো মানুষ পদ্মার পাড়ে বসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছে একটি সেতুর জন্য? ফেরির জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে যে রোগীটা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিলো সে জানে সেতুটা কতো প্রয়োজন ছিলো, যে ছেলেটা পদ্মার পাড়ে বসে চোখের জল ফেলেছে ফেরি না চলায় চাকরির পরীক্ষায় বসতে না পারার কষ্টে সে জানে সেতুটা কতো প্রয়োজন ছিলো!
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, মোটরসাইকেল নিয়ে পদ্মা সেতু পার হতে চাইলে টোল দিতে হবে ১০০ টাকা। কার ও জিপের জন্য ৭৫০ টাকা আর পিকআপের জন্য ১২০০ টাকা দিতে হবে। মাইক্রোবাসে লাগবে ১৩০০ টাকা। বাসের জন্য আসনের ভিত্তিতে তিন ধরনের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। ছোট বাসে (৩১ আসন বা এর কম) ১৪০০ টাকা, মাঝারি বাসে (৩২ আসন বা এর বেশি) ২০০০ টাকা এবং বড় বাসে (৩ এক্সেল) ২৪০০ টাকা টোল দিতে হবে। পণ্যবাহী বাহনের ক্ষেত্রে ছোট ট্রাক (৫ টন পর্যন্ত) ১৬০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক (৫ থেকে ৮ টন) ২১০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক (৮ থেকে ১১ টন) ২৮০০ টাকা এবং বড় ট্রাক (৩ এক্সেল পর্যন্ত) ৫৫০০ টাকা। চার এক্সেলের ট্রেইলারের ক্ষেত্রে টোল ৬০০০ টাকা। পায়ে হেটে বা রিক্সা ভ্যান সিএনজিতে পদ্মা সেতু পার হওয়া যাবেনা।
লিখতে গেলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখেও এই সেতুর গৌরবের কথা শেষ করা যাবেনা। আমাদের গর্ব নিজের টাকায় পদ্মা সেতু। দক্ষিনাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন আজ পূর্ন হয়েছে, বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি পদ্মা সেতু চালু হলে কমপক্ষে দেড় শতাংশ বাড়বে আশা করা যায়। অর্থনীতিতে এই সেতুর সুদূরপ্রসারী অবদান দৃশ্যমান হবে।বাংলাদেশ এগিয়ে যাক।।
