Muhit Kabir Sereniyabat
নির্মাণ শৈলীতে বিশ্বের বিস্ময় পদ্মা সেতু- বাংলার অর্থনীতিতে নতুন দিগন্তের আলো
পদ্মা সেতু প্রকল্প দেশের সর্ববৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প। সেতুটির নির্মাণ কাজ টেকনিক্যাল, সময়সাপেক্ষ ও চ্যালেঞ্জিং। গুণগতমান শতভাগ রাখার স্বার্থে ধৈর্য ও সর্তকতার সঙ্গে এগিয়ে যায় এ বিশাল নির্মাণ প্রকল্প। পদ্মার বুকে পূর্ণ অবয়ব নেওয়া ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের এই সেতু নিয়ে আলোচনা চলছে অন্তত দুই দশক ধরে। ২০০১ সালের ৪ জুলাই সে সময়ের সরকার প্রধান শেখ হাসিনা মাওয়া ঘাটে পদ্মা সেতুর প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের পাশাপাশি বেশকিছু মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হল ‘পদ্মা সেতু নির্মাণ’ প্রকল্প। এটি বাংলাদেশিদের জন্য একটি স্বপ্ন হিসাবে চিত্রিত বা রূপায়িত হয়েছিল। আর এ স্বপ্নের রূপকার ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃঢ় মনোভাবের বাস্তব রূপায়ণই আজকের পদ্মা সেতু। অসম্ভব কাজটিই সম্ভব হতে চলেছে এবং প্রায় আট বছরের নির্মাণ কাজ শেষে এই সেতু উদ্বোধন হতে যাচ্ছে ২৫শে জুন, ২০২২।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বসুনিয়া জানান, ২০১৩ সালের মার্চ কিংবা এপ্রিলে এই সেতুর কাজ ৬ মাসের মধ্যে শুরু করা যাবে কি না সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেন, “আমি একটু ঘাবড়ে যাই। আমি তখন বলি, আমার স্যার অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী যেহেতু আছেন, উনি থাকলে আমি পারব। উনি তখন স্যারকে ডাকলেন। স্যার বললেন, পারবেন। আমি স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি। জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার বললেন, সবকিছু রেডি আছে। আমি বুঝে ফেললাম; সবকিছু রেডি আছে ।” মূল সেতু, নদী শাসন, জাজিরা সংযোগ সড়ক, মাওয়া সংযোগ সড়ক ও দুই পাড়ে সার্ভিস এরিয়া তৈরি- এই পাঁচ ভাগে সেতুর কাজ শুরু হয়।
এর মধ্যে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর মূল সেতু নির্মাণ ও নদী শাসন কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
পদ্মা নদী অত্যন্ত শক্তিশালী ও বিশাল। সারা বিশ্বে খরস্রোতা যতো নদী আছে তার একটি বাংলাদেশের পদ্মা নদী। এই নদীতে প্রবাহিত পানির পরিমাণ, নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা এবং তলদেশে মাটির ধরন – এসব কিছুর কারণে এর উপর সেতু নির্মাণ করা ছিল অসম্ভব রকমের কঠিন এক কাজ। যমুনা সেতু ও গঙ্গা নদীর ওপর তৈরি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণে অর্জিত জ্ঞান এই সেতুর নির্মাণকাজে ব্যবহার করা হয়েছে। এই পদ্মা নদী একটি অ্যালুভিয়াল নদী অর্থাৎ পলল-শিলার মধ্য দিয়ে এই নদী একে বেঁকে সাপের মতো প্রবাহিত হচ্ছে। এর পাড়ও ভাঙে খুব বেশি। পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে বিশেষজ্ঞ দলের একজন সদস্য ড. আইনুন নিশাত, যিনি নদী ব্যবস্থাপনার কাজ তদারকি করেছেন, তিনি বলছেন পদ্মার তলদেশে এবং দু’পাশে নরম মাটি ও বালি। শীতের সময় পদ্মা নদীতে গভীরতা থাকে ১০০ ফুটের কাছাকাছি। বর্ষার সময় এই গভীরতা দ্বিগুণ হয়ে যায়।
মৌসুমে মৌসুমে এই নদীর চরিত্র পাল্টায়। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র দুই নদ–নদীর মিলিত শক্তি হচ্ছে পদ্মার। প্রতি সেকেন্ডে এই নদীর পানি ১৫ ফুট পর্যন্ত এগিয়ে যায়। নদীর ব্যাপকতায় ঘূর্ণিঝড়ও আঘাত হানতে পারে। এক ঋতুতে শান্ত পদ্মাই আরেক ঋতুতে হয়ে ওঠে প্রমত্ত। পাল্টে যায় নদীর আকার আয়তন থেকে শুরু করে পানি প্রবাহের চরিত্রও। এর চাইতে বেশি পানির প্রবাহ আছে পৃথিবীর একটি মাত্র নদীতে, সেটি আমাজন এবং ওই নদীর ওপর কোনো সেতু নেই। পদ্মার এই দোদুল্যমান চরিত্রকে মাথায় রেখেই সেতুর ভিত তৈরি করা হয়েছে বিশেষভাবে।
পদ্মার দুই পাশে ১৪ কিলোমিটার এলাকার তীর তৈরি করা হয়েছে। ড. আইনুন নিশাত বলেন, “সেতু রক্ষায় ব্যবহার করা হয়েছে ৮০০ কেজি ওজনের একেকটি জিওব্যাগ। নদীর তলদেশে ঢাল তৈরির জন্য ভারতের ঝাড়খন্ড থেকে আনা একেকটি এক টন ওজনের পাথর ফেলা হয়েছে। নদী শাসনে ব্যয় হয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা।”
পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর পাইলের সেতু হলো পদ্মা সেতু। বিশেষজ্ঞরা জানান, নদীর নিচের মাটি থেকে সর্বোচ্চ ৪১২ ফুট গভীরতায় বসেছে এই সেতুর একেকটি পাইল। মূল সেতুতে পাইল আছে ২৬৪টি। একেকটি পিলারের নীচে আবার ছয় থেকে সাতটি করে পাইল বসানো হয়েছে। বিশ্বে আর কোনো সেতুতে এতো গভীরে পাইল বসানোর দরকার হয়নি। বাংলাদেশের নদীতে পাথর নেই। ফলে সেতুর পুরো ভার রাখতে হয় মাটিতে। একারণে নদীতে অনেক ভারী পাথর, কংক্রিটের ব্যাগ এবং জিওব্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে। যেসব পাথর ব্যবহার করা হয়েছে তার এক একটির ওজন ৮০০ কেজি থেকে এক টন। “এসব পাথর একসাথে মিক্স করা হয়েছে যাতে ইন্টারলকিং হয়। সেগুলোকে নদীর তলদেশে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। নদীর তলদেশে যতটুকু যাওয়া সম্ভব, অর্থাৎ ড্রেজিং-এর ক্ষমতা যতোটুকু ছিল ততোটা গভীরে,” বলেন ড. আইনুন নিশাত। এজন্য পৃথিবীর বড় বড় তিনটি ড্রেজার আনা হয়েছিল। নদীর তলায় ৮০০ কেজির জিওব্যাগে লনামূলকভাবে মোটা বালি ভরে বটম লেয়ার তৈরি করা হয়েছে। “মাটির নিচে ২২৫ থেকে ২৩০ মিটার পর্যন্ত যেতে হয়। ১০ ফুট ডায়ামিটারের স্টিলের টিউবকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে মাটিতে বসাতে হয়। এজন্য প্রথমে ১০০০ টন তার পর ১৫০০ টন, ২০০০ টন, ২২০০ টন এবং তার পরে ২৫০০ টন- এভাবে হাতুড়ির ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে”, বলেন তিনি।
সেতুর নিচে নদীতে ৪০টি ও দুই পাড়ে দুটি পিয়ার (খুঁটি) বসানো হয়েছে। সেতুকে টেকসই করতে নদীর অংশের খুঁটির নিচে চীন থেকে আনা তিন মিটার ব্যাসার্ধের ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত ইস্পাতের পাইল বসানো হয়েছে; যা বিশ্বের সবচেয়ে গভীর ও মোটা পাইল। কংক্রিট এবং স্টিল দিয়ে তৈরি দ্বিতল এই সেতুর নকশা করেছে এইকম, স্পেক ইন্টারন্যাশনাল, এসিই কনসালটেন্স এবং নর্থ ওয়েস্ট কনসালটেন্স লিমিটেড।
ড. নিশাত বলেন, পদ্মা সেতুতে পানির স্রোত যখন দুই মিটারের কম ছিল তখনই সেতুর নির্মাণ কাজ চালানো হয়েছে। বর্ষাকালে কাজ করা অসম্ভব একটি ব্যাপর ছিল। কারণ তীব্র ¯্রােতের কারনে সেখানে কোনো বার্জ রাখা সম্ভব হয় না। স্টিলের তার দিয়ে বার্জ বেঁধে রাখার পরেও সেই তার ছিঁড়ে বার্জ ভেসে গেছে পানির স্রোতে। বর্ষাকালে নির্মাণ কাজের সময় পদ্মা নদীতে বার্জ, ড্রেজার ও ক্রেনকে থর থর করে কাঁপতে দেখা গেছে। তারা বলছেন সেতুটি এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যাতে এর শক্তিশালী পিলার নদীর প্রবল স্রোতের তোড়েও টিকে থাকতে পারে।
বেশি বৃষ্টি হলে প্রমত্তা পদ্মায় সাধারণ নদীর তুলনায় স্রোত ও ঘনত্ব বেড়ে যায়। পলি জমে অনেক বেশি। সে কারণে নৌযান চলতে যাতে সমস্যা না হয়, সেজন্য পানি থেকে ৭০ ফুট উঁচুতে সেতু করা হয়েছে। এসব পাইলের ওপরই নির্মাণ করা হয় পিলার। এর ওপর বসানো হয় ইস্পাতের স্প্যান। পদ্মা সেতুতে স্প্যানের ওপর কংক্রিটের স্ল্যাব জোড়া লাগিয়ে তৈরি হয়েছে যান চলাচলের পথ। সেতুর সব উপকরণে সর্বোচ্চ মান নিশ্চিতের চেষ্টা করা হয়েছে. “ব্রিজটা যে বিয়ারিংয়ের ওপর বসেছে, সেটা একটা লেটেস্ট বিয়ারিং, পেন্ডুলাম বিয়ারিং। পদ্মা সেতুতে প্রায় ৩ লাখ টন রড, আড়াই লাখ টন সিমেন্ট, সাড়ে ৩ লাখ টন বালু, প্রায় ২ হাজার ১০০ টন বিটুমিন লেগেছে। এসব উপকরণ দেশ থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছে। সেতুতে ব্যবহার করা কংক্রিটের কিছু পাথর দেশ থেকে নেওয়া হয়েছে। বেশিরৃভাগই আনা হয়েছে ভারত, ভুটান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। কংক্রিটের গুণগত মান যাচাই করে তারপর কাজ করা হয়েছে। বিশেষ কিছু রড আনা হয়েছে চীন থেকে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাজ্য থেকে অ্যালুমিনিয়াম নেওয়া হয়েছে।
এই সেতুতে ২০টির বেশি দেশের জনবল, যন্ত্র ও উপকরণ ব্যবহার হয়েছে। সাড়ে ৩ হাজার টন ওজনের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হ্যামার এই সেতুতে ব্যবহার হয়েছে। ক্রেন ব্যবহার হয়েছে ৪ হাজার টনের। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ৪ হাজার প্রকৌশলী, কারিগর ও টেকনিশিয়ানের মধ্যে পাঁচশ’র বেশি ছিল বাঙালি। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র-যন্ত্রাংশ দিয়ে ফরিদপুরের ভাঙা অংশে একটি জাদুঘর নির্মাণ করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার (১৪ জুন) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশনা দেন বলে বৈঠক শেষে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম এ তথ্য জানান।
নির্মাণ শৈলীতে বিশ্বের বিস্ময় পদ্মা সেতু। একটি পিলার কমপক্ষে ৫০ হাজার টন ওজন বহন করতে পারবে। যা এই সেতুকে দিয়েছে সর্বোচ্চ ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও টিকে থাকার ক্ষমতা। ছোট-বড় কিছু কাজের শেষ পর্যায়ে পিচ ঢালাই দিয়ে সড়ক তৈরি করে যানবাহন চলাচলের জন্য প্রস্তুত করা হয় সেতু।
পানি সম্পদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য আইনুন নিশাত জানান, খরস্রোতা পদ্মায় পাইল বসানো ছিল অন্যতম জটিল কাজ। তিনি বলেন, উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প সহনশীলতা নিশ্চিত করতে পদ্মা সেতুর পাইলিং কাজে যে হ্যামার ব্যবহার করা হয়েছে সেটাও বিশেষভাবে তৈরি করে বিদেশ থেকে আনা হয়েছে।
পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে উন্নীত হবে। বর্তমানে প্রবৃদ্ধি আছে ৭ দশমকি ৮৬ শতাংশ। পদ্মা সেতু চালু হলে বাড়বে আরও ১ দশমিক ২ শতাংশ। আর রেল সেতু হয়ে গেলে মোট প্রবৃদ্ধি বাড়বে ২ শতাংশ। ফলে ভবিষ্যতে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে উন্নীত হওয়ায় কোনো সমস্যা হবে না। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের সুবিধা বাড়বে, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে এবং তাদের জীবনযাত্রার উন্নয়ন হবে।