ডিপ্রেশন

ডিপ্রেশন -অনিন্দ্য মাহবুব

একুশ শতকে মানুষের অন্যতম শত্রুর নাম ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতাএতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন শত শত মানুষ আত্মহত্যা করছে। Global Emotions Report 2022 অনুযায়ী, মানুষের সংখ্যা বিবেচনায় পৃথিবীতে ক্ষুদ্ধ, দুঃখীঅবসাদ গ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তমএকেক জনের ক্ষেত্রে বিষণ্ণতার যাত্রাটা একেক রকমেরএতে একজনের সঙ্গে আরেক জনের মিল থাকে না বললেই চলেতাই মানুষভেদে এর লক্ষণ হয় বিভিন্ন প্রকারসামাজিক বিচ্ছিন্নতা, প্রতিদিনের কাজ প্রতিদিন শেষ করতে না পারার মানসিক চাপ, সারাদিন শুয়ে-বসে থাকা, ইন্টারনেটে হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে নিজেকে ব্যস্ত রাখা, অন্যদের উপর চাপ সৃষ্টি হবে ভেবে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত না করা প্রভৃতিকে বিষণ্ণতার লক্ষণ হিসেবে ধরা হয়এর কারণপ্রতিকার অনুসন্ধানে গবেষণা চলছেএর ফলে মানুষ সব বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে প্রতিনিয়ত দুঃখের সাগরে নিমজ্জিত হতে থাকে; বারবার আনন্দ লাভের চেষ্টা করেও কাঙ্ক্ষিত সুখ অর্জন করতে পারে নাবিষণ্ণতার শিকার ব্যক্তি বারবার নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে, কিন্তু কেউ তা বুঝতে পারে না; আত্মহননের পর অহেতুক আয়োজিত হয় শোক সন্ধ্যা নামক পুনর্মিলনী উৎসব

বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত প্রথম আত্মহত্যামূলক কবিতা জীবনানন্দ দাশের আট বছর আগের একদিনতাঁর জীবন ছিল বিষণ্ণতায় পরিপূর্ণতাঁর কবিতাকে দুর্বোধ্য, অশ্লীলপ্রগতিবিরোধী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছিলপ্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালক প্রকাশের পর তিনি তা রবীন্দ্রনাথকে পড়তে পাঠিয়ে ছিলেনপড়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘জীবনানন্দের কবিত্ব শক্তি আছে কিন্তু সে ভাষা নিয়ে জবরদস্তি করছে, ওস্তাদি করছে, তার মুদ্রাদোষ আছে।’ জবাবে জীবনানন্দ বলেছিলেন, ‘সকলে কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ নজরুলও জীবনানন্দকে বড় কিছু মনে করেন নিএকজন একবার নজরুলকে বলেছিলেন, ‘জীবনানন্দ তো বলেন উপমাই কবিতা।’ প্রত্যুত্তরে নজরুল হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘‘তোমাদের এখন আর মা’তে হচ্ছে না, ‘উপ’মা দরকার?’’

কর্মজীবনে চাকুরি হারিয়ে বারবার জীবিকার চেষ্টা করতে করতে জীবনানন্দ বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে নাই কোনো বিশুদ্ধ চাকরিবেকাররা তো বসে থাকে না, তারা দৌড়ায়, ছুটেবেড়ায়কেবল ভালো অবস্থানের লোকদের জন্যই বরাদ্দ আছে ইজিচেয়ার, কুশন, সোফা বা বিছানার অনন্ত শৌখিনতা।’ পারিবারিক জীবনেও তিনি অবসাদগ্রস্ত হয়ে লিখেছিলেন, ‘কেনই বা মানুষ বিয়ে করতে যায়? আজ রাতেই হয়তো লক্ষলক্ষ লোকে বিবাহের উৎসব খেতে গিয়েছে এবং কোটি কোটিলোক তাদের জয়-জয়কার করছেকিন্তু কাল তাদের কাছথেকেই ঢের সত্য শোনা যাবে; সেগুলো মোটেও ভরসাজনক নয়।’

কাব্যিক, কর্মকেন্দ্রিকপারিবারিক চাপ জীবনানন্দকে ধীরে ধীরে আত্মহত্যাপ্রবণ করে তুলেছিলব্যক্তিগত ডায়েরিতে সাগরে ডুবে আত্মহত্যার ইচ্ছে প্রকাশের পাশাপাশি তিনি লিখেছিলেন, ‘মৌমাছি যত আনন্দেই উড়ুক, তাকে ঠুকরে খাবার জন্য আছে দাঁড় কাকপ্রজাপতি যে ফুর্তিতেই তার রঙিন পাখা মেলুক, সেই পাখা ছিড়বার জন্য প্রস্তুত আছে দুষ্ট ছেলের দলএকজনের আনন্দ নস্যাকরার জন্য বরাবর ওত পেতে আছে অন্যজন।’

জীবনানন্দের কবিতায় স্বপ্ন, ঘোর, ক্ষোভ, ক্রোধ, পৌরুষ, নারীত্ব, প্রেম, বিরহ, হতাশা, আক্ষেপমৃত্যুচিন্তা মিলে মিশে সৃষ্টি করেছে রহস্যময় বিষণ্ণতারআলোচ্য কাব্যগ্রন্থে বিভিন্নপর্বেসব বিষয়ের পাশাপাশি আন্তর্জাল বাইন্টারনেট জীবনকে চিত্রিত করার চেষ্টা করা হয়েছেকারণ, ইন্টারনেটে মানুষ নিজেকে অপরের সাথে তুলনা করতে করতে কখনো উগ্রতা আর কখনো হতাশার পথে পরিচালিত হয়, যা এক পর্যায়ে পরিণত হয় মৃত্যু চিন্তায়অপার মৃত্যু চিন্তায় আসক্ত মানুষ অবসাদচ ক্রে ঘুরতে থাকেগ্রন্থের প্রতিটি কবিতা একেকটি গল্প; প্রতিটি পর্বের অন্তর্ভুক্ত কবিতাসমূহ মিলে আরেকটি গল্প; সব পর্ব মিলে একটি পূর্ণাঙ্গ গল্প এবং পুরো বইটি সামগ্রিক বিষণ্ণতার গল্প হিসেবে চার স্তরের গল্পমালার সমন্বয়ে গ্রন্থের কাঠামো প্রস্তুত করা হয়েছেপর্বসমূহের থিম প্রকাশার্থে বিভিন্ন ব্যান্ডের গান ব্যবহৃত হয়েছেজীবনানন্দ ছাড়াও বহু কবির কবিতার দেয়ালে পড়েছে অবসাদের ছায়াকাব্যগ্রন্থ রচনাকালে তাই বিভিন্ন কবিকবিতার প্রভাব পড়েছেসম্পাদনায় অনন্য ভূমিকা রাখার জন্যে অনিঃশেষ কৃতজ্ঞতা রইলো মোঃ কবীর হোসেন পলাশ ভাইখালিদমারুফ ভাইয়ের প্রতিভাবার্থে সংযুক্ত ছবিগুলো কবিতা-লেখকের তোলাগ্রিক দার্শনিক প্লুটার্কের ভাষায়, Painting is silent poetry and poetry is painting that speaks.

জীবনানন্দের কবিতার প্রতি সমসাময়িক চিন্তাধারার দিকে লক্ষ্য করলে বাঙালি কবিতা পাঠকের সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করা যায়সে সময় বেশিরভাগ পাঠক তাঁর কবিতা অনুধাবনে অক্ষম হওয়ায় তাঁকে কবি হিসেবে স্বীকার করার পরিবর্তে খারিজ করে দিয়েছিলেনএই সীমাবদ্ধতা অনুধাবনে নোবেল সাহিত্য পুরষ্কার প্রাপ্ত চিলির কবি পাবলো নেরুদার একটি বক্তব্য স্মরণ করা যায়: ‘কবিতা কখনো স্থির নয়, তা জল স্রোতের মতোমাঝে মাঝে এটি কবির হাতের নাগাল থেকে বেরিয়ে যায়সেখানে কোনো পদার্থ থাকতে পারে, আবার না-ও থাকতে পারেএটি এমন বস্তু হতে পারে-যা আছে, বা যা একেবারেই নেইকবিতার মাধ্যমে মানুষকে দিতে হয় জীবন দর্শনের অনুভূতিএতে চাই কবির নিজস্ব ভঙ্গিমাতানা হলে কবিতা হবে মৃতআর কবি? কবি সেই কবিতার মধ্যেই তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেনকারণ নিজস্বতা না থাকলে ধার করা নিঃশ্বাসে কবি বাঁচতে পারেন নাকোন লেখা ছোট হবে, কোনটা বড়, কার রং হবে লাল, কার হলুদ-এসব আইনের স্রষ্টা কে? একমাত্র কবিরই অধিকার আছেআইন তৈরি করারযে কবি বাস্তব অস্বীকার করেন, তিনি মৃতআবার যে কবি শুধু বাস্তবকেই স্বীকার করে লেখেন, তিনিও মৃতবিচার বুদ্ধিহীন কবিকে একমাত্র তিনিতাঁর প্রেমিকা ছাড়া কেউ বুঝবে নাআবার প্রখর বিচার সম্পন্ন কবিদের একমাত্র গর্দভ ছাড়া কেউ বুঝবে নাপৃথিবীর কোনো আইনের নির্দেশে কবিতা জন্ম লাভ করে নাভগবান বা শয়তান-কারো নির্দেশেই কবিতা চলে না, যদিও এদের প্রচণ্ড প্রভাব কবিতায় বিদ্যমানতবে কবিতা এদের কারো কাছেই পরাজিত নয়।’

অনেকেই কবিতা পড়ে বুঝতে না পেরে মনে করেন, দেশে কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশিউল্লেখ যোগ্য সংখ্যক বাঙালি পাঠক বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত নন বিধায় বাংলায় প্রচলিত কাব্য স্রোতের গভীরে বহমান চোরা কবিতার স্রোত তাঁদের চিন্তা ক্ষেত্রের ফোর ক্রস ফোর ম্যাট্রিক্স ভেদ করতে পারে না। ৪*৪ ম্যাট্রিক্স বলতে চার সিলে বলের দ্যোতনাকে বোঝানো হচ্ছেনিচের কবিতাটি লক্ষ্য করা যাক:

আজ দুপুরে ডাল খেয়েছি

কালকে রাতে খাবো কী?

কাল খেয়েছি ভুলেই গেছি

জানলে লোকে বলবে, ছিঃ!

এটা ৪*৪ ম্যাট্রিক্স এর উদাহরণএখানে চারটি সিলেবলে আবৃত্তির ছন্দটাকে বুঝা যাচ্ছেএবার এই ছন্দ অনুযায়ী মনের মাধুরী মিশিয়ে যা ইচ্ছে তা দিয়ে শব্দগুলোকে প্রতিস্থাপন করেদেখা যাক:

সব আলোতে চাঁদ দেখি না

তোমার আলোয় দেখবো আজ

সূর্য চোখে ম্লান হয়ে যায়

দেখলে পরে তোমার সাজ

ধরণের ফোর ক্রস ফোর ম্যাট্রিক্স লিখে বাংলার কাব্য-ইতিহাসে অনেকেই কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেনকেউ কেউএই ছন্দ পরিবর্তন করে অন্যান্য মাত্রার ম্যাট্রিক্স তৈরি করেথাকেনযেমন, উপর্যুক্ত কবিতাটি ৪*৪*২*২*৪*৪ আকারে ইম্প্রোভাইজ করা যাক:

সব আলোতে চাঁদ দেখি না

তোমার আলোয় দেখবো আজ

হায় সুন্দর

ক্লান্ত নগর

সূর্য চোখে ম্লান হয়ে যায়

দেখলে পরে তোমার সাজ

এরকম প্রচলিত ছন্দ ধরতে পারলে তা কবিতা, আর না পারলে তা কবিতা নয়-জাতীয় মূল্যায়নই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালি কবিতা পাঠকের মূল ব্যর্থতা, কবির ব্যর্থতা নয়এখন পর্যন্ত চৌত্রিশ জন কবি নোবেল সাহিত্য পুরষ্কার পেয়েছেন। ২০১১ সালে এই পুরষ্কার পেয়েছেন সুইডিশ কবি টমাস ট্রান্সটোমারতাঁর একটি কবিতার সূচনা নিম্নরূপ:

The ice bound river is blazing with sun

Here is the world’s roof

Silence.

এটি পড়ে অনেকেই হয়তো ছন্দটা ধরতে পারবেন নাতাই উনি যদি নোবেলজয়ী কবি না হতেন, তবে বাঙালি পাঠকের অনেকেই তাঁকে কবি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করতেন নাএটি সাহিত্যতত্ত্ব সম্পর্কে পাঠকের অজ্ঞানতার ফসলপাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্বের আলোকে ক্লাসিসিজম, রোমান্টিসিজম, বাস্তববাদ, প্রকৃতিবাদ, ডাডাবাদ, অধিবাস্তববাদ, পরাবাস্তববাদ, সিম্বলিজম বা প্রতীকবাদ, ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদুবাস্তবতা, মার্ক্সবাদ, মডার্নিজম, পোস্ট-মডার্নিজম, কলা কৈবল্যবাদ কিংবা প্রাচ্য সাহিত্যতত্ত্বের আলোকে জাপানি হাইকুঅন্যান্য সাহিত্য সম্পর্কে অজ্ঞতা পাঠকের সীমাবদ্ধতা; কবির নয়কবিতা লিখতে সাহিত্যতত্ত্ব না জানলেও চলেকারণ ব্যকরণ ভাষাকে অনুসরণ করে, ভাষা ব্যকরণকে নয়কিন্তু কবিতার সমালোচনা করতে হলে কম-বেশি সাহিত্যতত্ত্ব সম্পর্কে জানা প্রয়োজন, বেরিয়ে আসা প্রয়োজন ফোর ক্রসফোর ম্যাট্রিক্স এর অভিশাপ থেকে

তাই সকল কবির উদ্দেশ্যে আহ্বান একটাই: হে কবি! তুমি লিখে যাও, রচিতে থাকো অমর অক্ষয় কাব্যহয়তো আজ নয়, হয়তো শতবর্ষ পর কোনো একদিন তোমার ভাষা, তোমার আখ্যান, তোমার উপাখ্যান ধ্বনিত হবে অন্য কোনো কবির কণ্ঠে; আনমনে গুন গুন করতে করতে মধ্য রাতেআকাশে সেদিন বসবে লক্ষ তারার মেলা, সাগরে উঠবে ফেনিল ঢেউ, বাইরের হালকা বাতাস মনকে একটু দোলন দেবে, মস্তিষ্কে দেবে দোলনচাঁপার গন্ধ মাতাল ঢেউ, তারপর হারিয়ে যাবে সমুদ্রে যেমন ফেনারা হারায়তবুও সেই মুহূর্ত টুকুর জন্য লিখে যাওথাকবে না, হয়তো থাকবে না তুমি সেদিনতবে তোমারকণ্ঠস্বর কবিতার শব্দে শব্দে রয়ে যাবে অমর, অক্ষয় কোনো এক মধ্য রাতের অনুভূতি হয়ে, অবসাদের পথে অথবা বিপরীতে

 

 

 

লেখক, অনিন্দ্য মাহবুব, রোডস এন্ড হাইওয়ে

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *